রবীন্দ্র সংগীত

(1)

যদি তোর   ডাক শুনে কেউ না আসে   তবে   একলা চলো রে।
একলা চলো,   একলা চলো,   একলা চলো,   একলা চলো রে ॥
যদি   কেউ কথা না কয়,   ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি   সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে   সবাই করে ভয়--
                   তবে   পরান খুলে
ও তুই   মুখ ফুটে তোর মনের কথা   একলা বলো রে ॥
যদি   সবাই ফিরে যায়,   ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি   গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়--
                   তবে   পথের কাঁটা
ও তুই   রক্তমাখা চরণতলে   একলা দলো রে ॥
যদি   আলো না ধরে,   ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি   ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে   দুয়ার দেয় ঘরে--
                   তবে   বজ্রানলে
আপন   বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে   একলা জ্বলো রে ॥

 (2)

 তোর   আপন জনে ছাড়বে তোরে,
              তা ব'লে    ভাবনা করা চলবে না।
          ও তোর          আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
              হয়তো রে ফল ফলবে না ॥
আসবে পথে আঁধার নেমে,       তাই ব'লেই কি রইবি থেমে--
          ও তুই      বারে বারে জ্বালবি বাতি,
              হয়তো বাতি জ্বলবে না ॥
শুনে তোমার মুখের বাণী         আসবে ঘিরে বনের প্রাণী--
          হয়তো তোমার আপন ঘরে
              পাষাণ হিয়া গলবে না।
বদ্ধ দুয়ার দেখলি ব'লে  অমনি কি তুই আসবি চলে--
          তোরে       বারে বারে ঠেলতে হবে,
              হয়তো দুয়ার টলবে না ॥

(3)

এবার তোর   মরা গাঙে বান এসেছে,     'জয় মা' ব'লে ভাসা তরী ॥
ওরে রে     ওরে মাঝি, কোথায় মাঝি,    প্রাণপণে, ভাই, ডাক দে আজি--
     তোরা  সবাই মিলে বৈঠা নে রে,           খুলে ফেল্‌ সব দড়াদড়ি ॥
     দিনে দিনে বাড়ল দেনা,   ও ভাই,   করলি নে কেউ বেচা কেনা--
                   হাতে নাই রে কড়া কড়ি।
     ঘাটে বাঁধা দিন গেল রে,     মুখ দেখাবি কেমন ক'রে--
              ওরে,   দে খুলে দে,   পাল তুলে দে,   যা হয় হবে বাঁচি মরি ॥

(4)

নিশিদিন   ভরসা রাখিস,   ওরে মন,   হবেই হবে।
যদি পণ     করে থাকিস      সে পণ তোমার রবেই রবে।
              ওরে মন,   হবেই হবে ॥
পাষাণসমান আছে পড়ে,          প্রাণ পেয়ে সে উঠবে ওরে,
     আছে যারা বোবার মতন তারাও কথা কবেই কবে ॥
সময় হল, সময় হল-- যে যার আপন বোঝা তোলো রে--
     দুঃখ যদি মাথায় ধরিস সে দুঃখ তোর সবেই সবে।
ঘণ্টা যখন উঠবে বেজে     দেখবি সবাই আসবে সেজে--
     এক সাথে সব যাত্রী যত একই রাস্তা লবেই লবে ॥

(5)

আমি ভয়        করব না ভয় করব না।
     দু বেলা      মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না ॥
তরীখানা বাইতে গেলে  মাঝে মাঝে তুফান মেলে--
তাই ব'লে হাল ছেড়ে দিয়ে  ধরব না,       কান্নাকাটি ধরব না ॥
শক্ত যা তাই সাধতে হবে,  মাথা তুলে রইব ভবে--
সহজ পথে চলব ভেবে   পড়ব না,    পাঁকের 'পরে পড়ব না ॥
ধর্ম আমার মাথায় রেখে     চলব সিধে রাস্তা দেখে--
বিপদ যদি এসে পড়ে          সরব না,    ঘরের কোণে সরব না ॥

 (6)

আপনি অবশ হলি, তবে   বল দিবি তুই কারে?
     উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া, ভেঙে পড়িস না রে ॥
করিস নে লাজ, করিস নে ভয়,   আপনাকে তুই করে নে জয়--
     সবাই তখন সাড়া দেবে   ডাক দিবি তুই যারে ॥
বাহির যদি হলি পথে    ফিরিস নে আর কোনোমতে,
     থেকে থেকে পিছন-পানে চাস নে বারে বারে।
নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে,    ভয় শুধু তোর নিজের মনে--
     অভয়চরণ শরণ ক'রে      বাহির হয়ে যা রে ॥

(7)

আমরা   মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।
          ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক'দিন থাকে?।
          প্রাণের মাঝে থেকে থেকে   'আয়' ব'লে ওই ডেকেছে কে,
সেই          গভীর স্বরে উদাস করে--         আর কে কারে ধরে রাখে?।
          যেথায় থাকি যে যেখানে   বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
সেই          প্রাণের টানে টেনে আনে-- সেই   প্রাণের বেদন জানে না কে?।
          মান অপমান গেছে ঘুচে,   নয়নের জল গেছে মুছে--
সেই          নবীন আশে হৃদয় ভাসে ভাইয়ের পাশে ভাইকে দেখে ॥
          কত দিনের সাধনফলে   মিলেছি আজ দলে দলে--
আজ    ঘরের ছেলে সবাই মিলে   দেখা দিয়ে আয় রে মাকে ॥

(8)

আমরা       সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে--
              নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
আমরা       যা খুশি তাই করি,   তবু   তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা       নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে--
              নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
রাজা         সবারে দেন মান,    সে মান    আপনি ফিরে পান,
মোদের      খাটো ক'রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে--
              নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা       চলব আপন মতে,    শেষে     মিলব তাঁরি পথে,
মোরা        মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে--
              নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।

(9)

 সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।
        সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়,    আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।
        দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
        নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়,    নিজের 'পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
        ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
        নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়,    দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়॥


(10)

নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার--
জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার ॥
খনে খনে তুই হারায়ে আপনা   সুপ্তিনিশীথ করিস যাপনা--
বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার ॥
স্থলে জলে তোর আছে আহ্বান, আহ্বান লোকালয়ে--
চিরদিন তুই গাহিবি যে গান সুখে দুখে লাজে ভয়ে।
ফুলপল্লব নদীনির্ঝর   সুরে সুরে তোর মিলাইবে স্বর--
ছন্দে যে তোর স্পন্দিত হবে আলোক অন্ধকার ॥

(11)

পূর্ণ করি মহাকাল পূর্ণ করি অনন্ত গগন,
নিদ্রামগ্ন মহাদেব দেখিছেন মহান্‌ স্বপন্‌।
          বিশাল জগৎ এই
          প্রকাণ্ড স্বপন সেই,
হৃদয়সমুদ্রে তাঁর উঠিতেছে বিম্বের মতন।
উঠিতেছে চন্দ্র সূর্য, উঠিতেছে আলোক আঁধার,
উঠিতেছে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের জ্যোতি-পরিবার।
উঠিতেছে, ছুটিতেছে গ্রহ উপগ্রহ দলে দলে,
উঠিতেছে ডুবিতেছে রাত্রি দিন, আকাশের তলে ।



0 comments:

Post a Comment

টিপস

কপিরাইট-২০১৭ © মুহাম্মদ আলম
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত।
মোবাইল নং:- ০১৮১৩-......